চালের আমদানি শুল্ক তুলে দেয়ার চিন্তা

কাঙ্ক্ষিত গতি পাচ্ছে না চলতি বোরো মৌসুমের ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান। গত দুই মাসে সারা দেশে সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৫১ হাজার টন ধান এবং আড়াই লাখ টন চাল।

অথচ সরকারের টার্গেট ৮ লাখ টন ধান এবং সাড়ে ১১ লাখ টন চাল। সরকারি মূল্যের চেয়ে বাজারে দাম বেশি হওয়ায় গুদামে ধান-চাল দিচ্ছেন না কৃষক ও মিলাররা। ফলে বোরো সংগ্রহে বেহাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

বাজারে প্রতিদিনই বাড়ছে ধান-চালের দাম। সরকারের অভিযোগ, করোনার মধ্যেও আড়তদার-মিলাররা সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়াচ্ছে। এমতাবস্থায় মিলারদের কারসাজি রোধে প্রয়োজনে চালের আমদানি শুল্ক তুলে দেয়া হবে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

এ বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা আশা করি মিলাররা সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ চাল সরকারি গুদামে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমা দেবেন। এখন ভরা মৌসুম; এ সময়ে চালের দাম বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই। তারপরও চালের দাম বাড়ছে। ইতোমধ্যেই সরকার চাল আমদানি করার চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছে।

প্রয়োজনে চালের আমদানি শুল্ক তুলে নেয়া হবে। করোনার সময়ে অপচেষ্টার মাধ্যমে যদি চালের মূল্য বাড়ানো হয়, তাহলে সরকারিভাবেই চাল আমদানি করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। চালের বাজার অস্থিতিশীল হলে সরকার কঠোর অবস্থানে যাবে।’

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, মিলারদের কারসাজি মোকাবেলায় সরকার চাল আমদানি করে মজুদ বাড়ানোর চিন্তা করছে। প্রয়োজনে আমদানি শুল্ক তুলে দেয়ার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও এনবিআরকে তারা প্রস্তাব পাঠাবে। তার আগে চালকল মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করতে পারে খাদ্য মন্ত্রণালয়। মিলারদের শেষ সুযোগ দিতে চায় সরকার।

এর আগে ২০১৯ সালের ২২ মে চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে চাল আমদানিতে শুল্ক কর বৃদ্ধি করা হয়। ওই সময় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চালের ওপর বর্তমানে প্রযোজ্য আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ বহাল রেখে রেগুলেটরি ডিউটি ৩ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে।

একই সঙ্গে ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর আরোপ করা হয়েছে। ফলে চাল আমদানির ক্ষেত্রে বর্তমানে মোট করভার ৫৫ শতাংশ।

জানা গেছে, গত ৩০ এপ্রিল খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটি ১৯ লাখ ৫০ হাজার টন বোরো ধান-চাল কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। পাশাপাশি সরকারি গুদাম খালি থাকাসাপেক্ষে আরও ধান-চাল কেনা হবে বলেও ওই কমিটি সিদ্ধান্ত দিয়েছিল।

এরপর আরও ২ লাখ টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত দেয় কমিটি। ফলে চলতি বোরো মৌসুমে ২৬ টাকা কেজি দরে ৮ লাখ টন ধান, ৩৬ টাকা কেজি দরে ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল এবং ৩৫ টাকা কেজি দরে দেড় লাখ টন আতপ চাল কেনার কথা। গত ২৬ এপ্রিল থেকে ধান এবং ৭ মে থেকে বোরো চাল সংগ্রহ শুরু হয়েছে; যা আগামী ৩১ আগস্ট শেষ হবে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ২৪ জুনের হিসাব অনুযায়ী গত দুই মাসে সারা দেশে ধান সংগ্রহ করা হয়েছে মাত্র ৫১ হাজার ১৩৮ টন। আর চাল (সিদ্ধ) সংগ্রহ হয়েছে ২ লাখ ১ হাজার ৮৮৫ টন, আতপ চাল ২৩ হাজার ৮৫০ টন; যা কাঙ্ক্ষিত নয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে খাদ্যমন্ত্রী একাধিকবার মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সংগ্রহের গতি বাড়াতে তাগিদ দিয়েছেন।

কিন্তু খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, খোলাবাজারে এবার ধানের দাম বেশি। ফলে চাষীরা গুদামে আর ধান দিচ্ছেন না। করোনা পরিস্থিতিতে চালের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়েছে। চাল সরবরাহে মিল-মালিকরা সরকারি প্রণোদনা পাচ্ছেন। তাই মিল-মালিকরা বাজার থেকে ধান কিনে চাল তৈরি করছেন। এ কারণে বেড়ে গেছে বোরো ধানের দাম।

তাই চাষীরা খাদ্যগুদামে ধান না দিয়ে বাজারে বিক্রি করছেন। যে কারণে খাদ্য বিভাগের বোরো ধান সংগ্রহ অভিযান মুখ থুবড়ে পড়েছে। মিলাররাও চুক্তি অনুযায়ী সরকারি গুদামে চাল দিচ্ছেন না বলে অভিযোগ খাদ্য কর্মকর্তাদের। এদিকে করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারি গুদামে মজুদও দিন দিন কমে যাচ্ছে। ২৪ জুনের হিসাব অনুযায়ী ৯ লাখ টন চালসহ ১২ লাখ টন খাদ্য মজুদ রয়েছে।

এদিকে টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, সিলেট এবং সুনামগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ডুবে গেছে লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলও। এমতাবস্থায় সরকারি মজুদে দ্রুত টান পড়তে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

তাদের মতে, করোনা ও বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হলে দ্রুত মজুদ বাড়াতে হবে। এতে বাজারে চালের দামও স্থিতিশীল হবে। মিলারদের কারসাজির বিষয় অস্বীকার করে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. লায়েক আলী যুগান্তরকে বলেন, ‘সরকার চাইলে যে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

তারা চালের দাম বৃদ্ধির জন্য মিলারদের সিন্ডিকেটের কথা বলছেন। বাস্তবতা হল- করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশের অধিকাংশ চালকল বন্ধ প্রায়। যেগুলো চালু রয়েছে গত ১৫-২০ দিন ধরে বৃষ্টির কারণে ধান শুকিয়ে চাল করা যাচ্ছে না। সরকার মাঠের সত্যিকার অবস্থার খোঁজ নিলেই জানতে পারবে। কারা কত টাকা দরে ধান-চাল কিনছে তা খুঁজে বের করে মজুদদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই তো হয়। কোনো কিছু তো সরকারের অজানা নয়।

একদিকে দাম বাড়িয়ে বলবেন কৃষক বাঁচাতে ধানের ন্যায্য দাম দিতে হবে; আবার ধানের দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই চালের দাম বাড়বে। চালের দাম বাড়লে সরকার-মিডিয়া মিলে মিলারদের সিন্ডিকেটে বা কারসাজির কথা বলবেন।

আমরা কোন দিকে যাব। সরকারি গুদামে চাল দেয়ার ক্ষেত্রে মাঠে কিছু সমস্যার কথা আমাদের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। বিষয়টি আমরা খাদ্য অধিদফতরকেও বলেছি। আশা করি মন্ত্রণালয় শিগগিরই এর একটি বিহিত করবেন।’